অনুভবে
হুমায়রা হারুন
টনি, রুম্পা, জনি আজ ঠিক করেছে সারাদিন কাটাবে ওদের ট্রি হাউজে। বাড়ির পিছনে
বিশাল বাগান জুড়ে অনেক গাছ গাছালীর সমাহার। ওখানেই ওদের তিন ভাইবোনের জন্য
বানানো হয়েছে ট্রি-হাউজ। প্রায় দোতলার সমান উচ্চতা হবে। সেই উঁচুতে ১০ ফুট বাই
৮ ফুট একটি ঘর। ঘরটির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই শহরের নামকরা একটি চিড়িয়াখানা।
আসলে চিড়িয়াখানার পাশেই বাড়ি বানাবার জন্য প্লটটি পেয়েছিলেন ওদের বাবা সেই কবে।
বাড়ি বানিয়ে কিছুটা খালি জমি রেখেছিলেন পেছনে। ছোট্ট একটা লন। কিছু গাছপালা।
নির্জন নিরিবিলি কোলাহলমুক্ত এ জায়গায় প্রতি সন্ধ্যায় বসে চা খেতে আর বাচ্চাদের
খেলা দেখতে দেখতে বাবা মায়ের সময় কেটে যায় ভীষণ আনন্দে। বাচ্চাদের আবদারে তাদের
জন্য ছোট্ট ট্রি হাউজ গড়ে দিয়েছেন তারা।
সপ্তাহের ছুটির সারাটা দিন, পারলে সারা রাতও তারা খেলতে খেলতে পার করে দেয়
ট্রি-হাউজে। অন্যদিন সকালে ঘুম না ভাঙ্গলেও ছুটির দিনে ঐ ট্রি-হাউজে খেলার
নেশায় খুব ভোরে ওদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। একটুও ইচ্ছে করে না বেলা পর্যন্ত ঘুমুতে।
সকাল হলেই দে ছুট।
আজও তাই করলো ওরা। সপ্তাহের এই ছুটির দিনটা সবচেয়ে বেশী আকাংখিত। তাই সকাল হতেই
তিনজন ওখানে। ওদের সব খেলনাগুলো ট্রিহাউজেই রাখা থাকে। তিনজনের মধ্যে টনি ১০,
রুম্পা ৮, জনি ৫ বছর। বড় হয়ে টনির এখন অনেক দায়িত্ব। নিজে খেলা করলেও ছোট
ভাইবোনকেও দেখাও তার কর্তব্য। ওদের খেয়াল রাখা আবার নিজের খেলা দুটোই তাকে করতে
হয়।
বলা নেই কওয়া নেই হঠাতই চোখে পড়লো রুম্পা একটু ঝুঁকে জানালার বাইরে কি যেন
দেখছে। টনি কাছে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াতেই দেখলো মনোরম এক দৃশ্য। ওদের ট্রি
হাউজের ঘরটি যেন আকৃতিতে বিশাল হয়ে মিশে গেছে ওই দূরের একটি ঝর্ণার সাথে। তাই
একটুও দ্বিধা না করে ওরা এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেল সেই ঝর্ণার দিকে। ঝর্ণার
পাশে চোখ জুড়ানো ফুলের বাগান আর তার মাঝে অনেকগুলো প্রজাপতি খেলা করছে। এ যেন
একদম রূপকথার স্বপ্নপুরী। আরেকটু সামনে এগুলো। বাহ কি সুন্দর! সামনে সবুজ ঘাসে
আবৃত বিশাল মাঠ আর তারই প্রান্তে ঢালু রাস্তা মিশেছে ঐ দূরের ছোট্ট একটি
গ্রামে। মাঠটা পার হয়ে দুজনে দৌড়ে চলে এলো রাস্তায়। তারপর ওই রাস্তা বেয়ে আরো
সামনে ঐ ছোট্ট গ্রামে। ওখানে যে আরো বিস্ময় ! তাদেরই মতন অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে
খেলা করছে। টনি আর রুম্পার তর সইলো না। এক দৌড়ে ওদের কাছে যেয়ে হাজির। বললো,
‘আমাদের খেলতে নেবে তোমাদের সাথে?’
শিশুগুলো ভীষণ মিশুক। তাই এক কথায় ওদেরকে বন্ধু করে নিল।
প্রথমেই ওরা জিজ্ঞেস করলো রুম্পা আর টনিকে, ‘তোমরাও কি আমাদের মতন এখানে এসেছ?’
আমাদের মতন মানে?
ওরা কিছুই বুঝে উঠতে না পারায় বাচ্চাগুলো হাসতে হাসতে দে ছুট। ওরাও সাথে সাথে।
তাদের সঙ্গে অনেক খেলাধূলোয় আর অনেক মজায় মেতে উঠলো। কিন্তু এত খেলেও যেন বিকেল
গড়িয়ে আর সন্ধ্যে নামছে না। বাবা মা বাসায় যাবার জন্য আর ডাকছে না ভেবে টনি আর
রুম্পার বেশ ভাল লাগলো। এমনটাই তো ওরা চেয়েছিল এতদিন। কিন্তু কখনই তা হয়নি। আর
আজ যেন যা চাওয়া তাই সাথে সাথে পেয়ে যাওয়া। বাবা মায়ের শাসন নেই। সময়ের বালাই
নেই। স্কুলে যাবার তাড়া নেই। খেলা আর খেলা।
ওদের নতুন বন্ধুদের নামগুলো বেশ মজার। সংখ্যা দিয়ে। যেমন ডি-ওয়ান, ডি-টু,
ডি-থ্রি, ডি১১. আর এভাবেই ওই নতুন ১১ জন বন্ধু ওদের কাছে নিজেরদের পরিচয় দিল।
টনিকে নতুন নাম না দিয়ে বললো, ‘থাক, তোমাদের নাম আপাতত টনি আর রুম্পাই থাক।’
সাথে সাথে দু’ ভাইবোনের প্রতিবাদ। ‘কেন? আমাদের নাম যদি তোমাদের নামের মতো
সংখ্যা দিয়ে হয় তাহলে মন্দ কি,আমাদের নামও তোমাদের মতন করে দাও।’ কিন্তু টনির
কথায় ওরা রাজী হলো না। বলল, ‘এখন নয়। পরে।’
রুম্পা বলল, ‘কেন এখন সম্ভব নয়? আমরা তো তোমাদের বন্ধু, তাইনা?’
শিশুরা খলখল করে হেসে উঠলো। শুরু হল হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি। বরফ পানি, হাইড
অ্যান্ড সিক, আরো কত খেলা।
খেলা শেষে পিপাসার্ত হয়ে এলো ঝর্ণার ধারে। পানির স্বাদ এত অন্যরকম যেন পানি তো
নয় এ এক প্রশান্তির আবেশ। সব ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও । তারপর আবার খেলা।
আশপাশের ফুলের গাছগুলোতে অনেক ফুল ফুটে আছে। নানা রঙের প্রজাপতি উড়ছে কিন্তু
ফুলগুলোর নাম না জানা। পাখিরা ডালে ডালে খেলা করছে। রুম্পা ভাবলো এই বাগানটার
ছবি আঁকলে কেমন হয়। রাস্তার ধারে বসে মাটিতে আঁচড় কেটে নিজের কল্পনা মিশিয়ে
এঁকে ফেললো ছোট্ট একটি হরিণ ছানারও ছবি। ওর এত্ত সুন্দর ছবি আঁকা দেখে সবাই
জানতে চাইলো এটা কি? রুম্পা বললো, ‘আমদের বাড়ির পাশে মস্তবড় একটা চিড়িয়াখানা
আছে। সেখানে খাঁচায় খাঁচায় বন্দী থাকে অনেক পশু পাখি। তারমাঝে ওর সবচেয়ে প্রিয়
হলো চিত্রা হরিণ। এটা তারই ছবি।’ ওর কথা শুনে ওর বন্ধুরা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস
করলো, ‘তোমাদের পৃথিবী এত্ত সুন্দর?’
এমন প্রশ্ন শুনে টনি বেশ অবাক হয়েই বললো, ‘পৃথিবীটা কি আমাদের একার, তোমাদের
না?’ ওরা সব্বাই একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘না তো! পৃথিবী থেকে তো তোমরা দুজনেই চলে
এসেছো বেশ কিছুক্ষণ আগে।’ টনি আর রুম্পা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না পৃথিবী থেকে
ওরা কোথাই বা চলে এসেছে? খুব উতসুক হয়ে জানতে চাইলে ওরা বুঝিয়ে বললো এখন তাদের
অন্য এক মাত্রার জগতে আগমন ঘটেছে। এ জগতটি হলো পৃথিবী থেকে আবার পরের জন্মে
ফিরে যাবার বিরতিস্থান। হতে পারে সেই পরের জন্ম হবে পৃথিবীতে বা সেই গ্রহ ছেড়ে
অন্য কোন গ্রহে। কিন্তু যেখানেই হোক না কেন প্রতিটি শিশুদের পৃথিবীর জীবন শেষ
করে নতুন জীবনচক্র শুরু করবার অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকু এ জগতেই কাটাতে হয়। আর
সেখানেই টনি আর রুম্পার অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাদের অজান্তেই। পৃথিবী ছেড়ে তারা চলে
এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু কিভাবে এলো এ প্রশ্ন করতেই ডি-ওয়ান বললো,
--তোমরা যখন ট্রি হাউজে খেলা করছিলে, তখন কি দেখেছিলে সুন্দর একটি বাগানের
দৃশ্য? রুম্পা আর টনি সাথে সাথে বলে উঠলো, ‘নিশ্চয়ই। আর তা দেখেই তো আমরা
হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করলাম ঐ সুন্দর বাগানে।’ সবচেয়ে ফুটফুটে বন্ধুটি তখন
বললো, ‘তারপর কি হলো জানো? যেইনা তোমারা ওই বাগানে প্রবেশ করলে সেই সময় তোমাদের
ছোট ভাইটি দেখল তোমরা দু’জন ট্রি হাউজের জানালা দিয়ে নীচে ধপ্পাস। বাড়ির সকলে
এসে দেখলো তোমাদের নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। তোমরা আর বেঁচে নেই।’
--তার মানে ? আমরা কি ওখানে মারা গিয়েছি।
-- মারা যাওনি। ডাইমেনশানের একটু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অতসত কি পৃথিবীর
মানুষেরা বোঝে? একদমই না । কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে সারাটা জীবন নষ্ট করে দেয়।
ভেবে নেয় প্রাণহীন হয়ে যাওয়া মানে অজানায় হারিয়ে যাওয়া। তারাও তোমাদের নিয়ে
এমনটিই ভাবছেন এখন। তারা জানতেও পারছেন না যে তোমরা এই সুন্দর বাগানে খেলা
করছো।’
টনি আর রুম্পা বেশ অবাক স্বরেই বললো, ‘আমাদের এই সুন্দর বাগানে আসবার কথা কি
বাবা মাকে জানানো যায়না?’
ডি-ওয়ান বললো, ‘মনে হয় না । কারণ তারা আছে মাত্র ত্রি-মাত্রিক জগতে আর আমরা যে
তার থেকেও অনেক বেশী মাত্রায় আছি। তারা আমাদের দেখতেও পাবে না, শুনতেও পাবে না,
বুঝতেও পারবে না।’
রুম্পার সাথে সাথে প্রশ্ন, ‘তাহলে আমরা এখন কত ডাইমেনশানে আছি?’
সব নতুন বন্ধুরা নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বললো, ‘ডাইমেনশন-১৩ তে। আর তাই ১৩
এর নীচে যতগুলো মাত্রার জগত আছে সব আমরা দেখতে পাই, অনুভব করতে পাই, কিন্তু
তারা তা পারেনা। তোমরা যেমন ত্রি- মাত্রার ঘনক, দ্বি-মাত্রার তল আর একক মাত্রার
বিন্দুর সংজ্ঞা জানো আমরাও তেমনি আরো বহুমাত্রিক জ্যামিতিক আকারের সংজ্ঞা জানি
যা অত ক্ষুদ্র পরিসীমায় তোমাদের ঐ পৃথিবী থেকে জানা সম্ভবই নয়।’
টনি বেশ অবাক হয়েই জানতে চাইলো, ‘আর ১৩ ডাইমেনশানের চেয়ে বেশী মাত্রা যদি হয় তা
কি তোমরা দেখতে পাও?’
ডি-ওয়ান বললো, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন জগতটির মাত্রা ১৩ বলেই এর বেশী মাত্রা
আমাদের জন্য অনুভবের উর্ধ্বে।পরবর্তীতে অন্য কোন গ্রহে অন্য কোন অবস্থায় কত
মাত্রায় নতুন জীবনচক্র লাভ করবো তাও আমরা জানি না। কিন্তু এইটুকু নিশ্চিত যে
আমাদের থেকে বেশী ডাইমেনশান সম্পন্ন সৃষ্টি এই মহাজগতেই আছে। তারা আমাদের
ইন্দ্রিয়গোচর না হলেও আমরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে সব সময়ই আছি।’
টনি আর রুম্পা আজ যেন অনেক কিছু ভাবতে পারছে নতুন করে। তারা নিমেষেই বুঝে
ফেলেছে উচ্চ মাত্রার সৃষ্টি কিভাবে নিম্ন মাত্রাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
কিন্তু সর্বোচ্চ কত মাত্রায় এই মহাজগত সৃষ্ট বলতে গিয়ে ডি-ওয়ান একটু থমকে গেল।
ভেবে বললো, ‘হয়তো বা অসীম মাত্রার।’
টনি বললো, ‘অসীম কেন হবে, একটা সংখ্যা তো হবে।’
ডি-সেভেন বেশ উতসাহের সাথে এগিয়ে এলো। বেশ সবজান্তার ভঙ্গীতে বললো,
--সংখ্যার হিসেবও তো এক এক মাত্রার জগতে এক এক রকম । পৃথিবীর মানুষদের হিসেব ০
থেকে ৯ পর্যন্ত। বাইনারি হিসেব ০ থেকে ১ পর্যন্ত। সুতরাং এ সংখ্যাতত্ত্বের কি
শেষ আছে? এখানেও হিসেব অন্যরকম। কিন্তু তোমরা তো সদ্য এসেছো পৃথিবী থেকে তাই
বোঝার সুবিধার্থে আমাদের নামগুলো ১ থেকে ১১ পর্যন্ত রেখেছি কারণ আমরা যে ১১ জন।
--কিন্তু তোমাদের কোন নাম থাকবে না সে জন্য?
--নামতো একটা বিশেষ্য। আমাদেরকে কি বিশেষভাবে বিশেষায়িত করার প্রয়োজন আছে?
--তাহলে কি আমাদের কোন বৈশিষ্ট্যও থাকবে না?
--প্রয়োজন কি আছে? আমরা যে পৃথিবীর মানুষদের দেয়া সকল বিশেষণের উর্ধ্বে।
--বাহ তাহলে তো সংগাই পালটে যাবে জীবনের।
--জীবনের নয়, অবস্থার। তোমরা দুজনেই এখন ট্রানজিশান অবস্থায় আছ। নতুন জীবন
বাছাইয়ের সময় প্যারামিটারগুলো আবার নির্ধারণ করে নেবে।
-- তাহলে এবার যদি এ জগত থেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই, পারবো কি?
-- না। কারণ এই সকাল থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে খেলা করছো ইতিমধ্যে পৃথিবীতে
তোমাদের অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে দুই যুগ পার হয়ে গিয়েছে। তোমাদেরকে
ধারণকারী দেহ, মাটির সাথে মিশে বিলীন হয়ে গেছে। ওখানে তোমাদের পার্থিব কোন
অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই।
এই সময়টুকুতে দুই যুগ পার হয়ে গেছে ভেবে টনি আর রুম্পা হেসে ফেললো। কিন্তু ওদের
কেন বয়স বাড়ছে না এ জগতে ? সময় কেন এগুচ্ছে না আর, কেন থেমে আছে? নিশ্চয়ই
পৃথিবীর থ্রি-ডি স্পেসের দেহে আর আবদ্ধ নেই বলেই হয়তো বা। তাই বুড়ো হবার ও
বালাই নেই। টনি বললো, ‘তাহলে আমরা এখন কি?’
--তোমরা এখন সত্ত্বা। এটাই তোমাদের পরিচয়। যদি তোমরা অন্য কোন গ্রহে যেয়ে
মানুষের দেহ ধারণ কর তাহলে মানুষ হবে। অথবা অন্য কিছু, যা তোমার মন চাইবে।
রুম্পা সাথে সাথে বললো, ‘আমি পৃথিবীতে গেলে ডলফিন হব আর সারাদিন জলের ভেতর খেলা
করবো।’ শুনে ডি-১১ বললো, ‘জানো আমি তিনজন্ম আগে ডলফিন ছিলাম। তারপর ঘাস ফড়িং
তারপর খরগোশ। সবগুলোই পৃথিবীর থ্রি-ডি স্পেসে।’
টনির ইচ্ছে হচ্ছে একটু পৃথিবী থেকে ঘুরে আসতে। সাথে রুম্পাও প্রস্তুত। যেই ভাবা
সেই কাজ। প্রথমেই হাজির হলো ওদের প্রিয় ট্রি-হাউজে। মনে হল যেন বহুদিন এখানে
কেউ আসেনি। খেলনাগুলো ধুলোর পুরু আস্তরণে ঢাকা। জানালার পাশ দিয়ে চিড়িয়াখানাটা
আর নেই। ওখানে হাউজিং সোসাইটির বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। সেই
সকালেই না ওরা বেরুলো ওই ঝর্ণা দেখতে আর তারই মাঝে এত্ত পরিবর্তন। তর সইলো না
ওদের বাবা মাকে দেখার। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলো লিভিং রুমে বসে রয়েছে
একজন বৃদ্ধ আর একজন বৃদ্ধা। নিশ্চুপ তারা। কারা এরা?
রুম্পা টনি কাছে যেয়ে দাঁড়ালেও টের পেলেন না তারা। ওরা চিনতে পেরেছে। ওনারা
তাদেরই বাবা মা। সত্যিই সময় বয়ে গেছে দুই যুগ। তাদের বার্ধক্যের ছাপ এবার তারই
নিশ্চিত প্রমাণ। কাছে যেয়ে তাদের ডাকলেও তারা শুনতে পেলেন না। দেখতেও পেলেন না।
কি করা যায় ভাবছে টনি। আর তখনই নীরবতা ভেঙে বৃদ্ধা তার স্বামীকে বললেন,
--আজ যেন ছেলেমেয়ে দুটোর কথা খুব বেশী বেশী মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে ওরা যেন আমার
খুব কাছেই আছে।
রুম্পা টনি তো হেসেই সারা। ওরা তো ওদের মায়ের সামনেই দাঁড়ানো। কেন যে মা দেখতে
পাচ্ছে না। আসলে ডাইমেনশান পরিবর্তনের এই এক ঝামেলা। একবার যদি পরিবর্তন ঘটে
তাহলেই তাকে বলা হয় অন্তর্ধান। রুম্পা টনিওরও এখন এই ডাইমেনশান থেকে অন্তর্ধান
ঘটেছে। তাই তারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। যতই কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকুক আর মা কে
জড়িয়ে বসে থাকুকনা কেন কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হবে না।
বৃদ্ধা আবারো বলে উঠলেন, ‘জানো, বাচ্চা দুটো যেন আমার খুব আছে এসে বসেছে।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবার ধীর গলায় বললেন, ‘একটা অদ্ভুত ব্যপার কি জানো, তুমি যখন
এমনটি ভাবছিলে, আমার মনেও ঠিক এমন চিন্তা এসেছে। আমরা যেন একই সময়ে একই কথা
ভেবে চলছি নিজেদেরই অজান্তে।’
টনি একটু হতাশ। কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে সে তাদের বড্ড কাছে। রুম্পা এবার
টনিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘আমরা অন্য জগতে, অন্য মাত্রায় আছি তো কি হয়েছে,
আমাদের দেখতে না পেলেই বা কি। দেখা বা শোনা তো চোখ আর কানের কাজ। তারা তো ঠিকই
আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়েছেন। পাননি?’
টনি মাথা নেড়ে সায় দিলেও চোখে তার প্রশ্ন, কিন্তু কিভাবে?
অনুভবে।
রুম্পার ছোট্ট একটি উত্তর যেন এবার নতুন বোধের জন্ম দিল।
অনুভবে।
ঠিক তাই।
অনুভবে।
সত্ত্বার অনুভবে।
সত্ত্বা সবসময় অপরিবর্তনশীল – তা যে কোন অবস্থায় হোক বা যে কোন মাত্রায়।
তাই বাস্তব বিবর্জিত বলে মানব মস্তিষ্ক যখন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে তুচ্ছ বিবেচনা
করে, মানব মন তখনও তার সত্ত্বার মাঝে সে সত্যকে অনুভব করে।